সময়টা ২০০৩ সালের জুলাই মাস। তখন ক্লাস
ফোরে পড়ি। খুব সকালে ঘুম
থেকে উঠে স্কুলে যেতে হতো। বর্ষার অঝর ধারায়
রাস্তাঘাট ভিজে একাকার। কোথায়ও
কোথায়ও
পানি জমে হাঁটার প্রায় অযোগ্য অবস্থা। সেদিন
স্কুল যাওয়ার সময় কাঁদামাখা রাস্তায়
পড়ে গিয়েছিলাম আমি। একেবারে স্কুল ড্রেসের
সর্বনাশ করে ছেড়েছিলাম। পেছন
থেকে কে জানি বলে উঠলো,
"বোয়াল মাছটা ধরেছো বেশ খুকি"।
কথাটা শুনেই পেছন ফিরে তাকালাম। আমাদের
ক্লাসের নিউ স্টুডেন্ট ছেলেটা। নাম জানি কি?
ও,মনে পড়েছে,নাম কোবরা। রাগে গজগজ
করছিলাম আমি।
"এই তোমার সমস্যা কি??" হুংকার ছেড়ে বল্লাম
আমি।
"কি ব্যাপার খুকি ব্যাথা পেয়েছো বুঝি??
চুহচুহচু...."
জিহ্বায় আগা বের করে কিরকম এক বিদখুটে শব্দ
করলো ছেলেটা।
আমি তখনো বসে আছি সেখানেই। বড্ড
বেশি অসহায়
লাগছিল নিজেকে তখন। হাত-পা সব
কাঁদামেখে যাচ্ছে তাই অবস্থা। উপায়
না পেয়ে রাস্তায়
ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করে দেই।
ছেলেটা হাত
বাড়িয়ে দিয়ে বলে,"উঠো খুকি কাঁদে না। " আবার
মুখ টিপে টিপে হাসছে..
ছেলেটার হাত সরিয়ে দিয়ে আমি নিজে নিজেই উঠে,
সাপের মত ফোস ফোস করতে বলি, "বেয়াদপ
কোথাকার। আমার নাম আছে বুঝলে।"
তারপরই বইয়ের ব্যাগটা হাতে নিয়েই বাসায়
ফিরে যাই।
পেছন থেকে এখনো খিলখিল হাসির
ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম।
রাগে চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো আমার।
***
স্কুল বাসার পাশেই ছিল। হেঁটে হেঁটেই
যাওয়া যায়। বাসায় ফিরে সিবিল ড্রেস পড়েই
স্কুলে যাই সেদিন।
ম্যাম আসার আগেই ক্লাসে যাই আমি।
আমি ক্লাসে প্রবেশ করার পরপরই চন্দনা ম্যাম
এলো। ম্যাম রোল কল ডাকার পরই,পড়ানো শুরু
করলেন। খুব মনোযোগ সহকারেই
ইংরেজি পড়াচ্ছিলেন ম্যাম। আমি দ্বিতীয়
বেঞ্চে বসেছি রাকিবার
সাথে। মেয়েটা আমার একদম পছন্দ করি না।
সবসময়
ওর নাক থেকে সর্দি পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর
পরই
তার নাক সিটাকানোর আওয়াজ,অসহ্য। আজ
যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছি তাই ভাবছি।
ভাবতে ভাবতেই জানালার
পাশে লতা জড়ানো নীলকন্ঠ গাছটার
দিকে নজর পড়লো। এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে,আমি পরানীল ফ্রকটার
সাথে নীলকন্ঠ গাছটার মিল
খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।
হঠাৎ কিছু একটা জিনিস খুব
জোরে কপালে এসে পড়ল। আমি অমনি "আউচ" শব্দ
করে, কপালে তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে বোর্ডের
দিকে তাকালাম। ম্যাম চক ছুড়ে মেরেছে আমার
কপালে।
ম্যাম রাগান্বিত কন্ঠে হুংকার ছেড়ে বলে,
"স্ট্যান্ড আপ।"
আমি থতমত খেয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাড়ালাম।
"বেঞ্চের উপর উঠে দাড়াও মেয়ে। ধ্যান
কোনদিকে তোমার??"
রগ চটা করে,চোখ জোড়া বড় বড় করে ম্যাম বললো।
আমি কৎ করে ঢোক গিললাম।
নিরবে শাস্তি মাথা পেতে কান
ধরে দাড়িয়ে গেলাম বেঞ্চের উপর।"
কে জানি পেছন থেকে ফিক করে হেসে দিল। পিছন
ফিরে দেখি ক্লাসের শেষ
বেঞ্চে বসে আছে কোবরা।
সেদিন কোনমতে রাগ
চেপে নিজেকে সামলে নেই,আমি।
***
মাএ দুদিন
হলো এসেছে ছেলেটা,আমাকে জ্বালিয়ে মারছে।
মনে হচ্ছে, নাকের ডগায় উপর
রেখে ডুগডুগি বাজাচ্ছে। প্রচন্ড
গাঁ জ্বালা করছিল আমার।
কোকরা কোকরা চুল,নাক বোঁচা,নাদুসনুদুস
শরীরের কৃষ্ণ বর্নের ছেলেটা প্রায় প্রতিদিনই
এইভাবে না হয় সেইভাবে আমাকে বিরক্ত করেই
যাচ্ছে।
ডলি দিদি সখ করে সেদিন মার্কেট
থেকে ১২টা কার্টুন সেপ রাবার কিনে দিয়েছিল।
আর স্কুল থেকে প্রতিদিনই আমার
একটা করে রাবার গায়েব হচ্ছে। বাসায়
এসে আজ প্রচুর উওম-মধ্যম খেয়েছি।
কাঁদতে কাঁদতে বেলকনিতে এসে দাড়ালাম।
পাশের দোতলা বাসা থেকে ধুপধাপ আওয়াজ
শুনতে পাচ্ছিলাম। নতুন
ভাড়াটে এসেছে মনে হয়। চোখ তুলে তাকাতেই
দেখি হতছাড়া কোবরা তাকিয়ে আছে আমার
দিকে।
"কি ব্যাপার খুকি কাঁদছিলে বুঝি?"
ফুটবলটা হাতে নিয়ে বললো কোবরা।
"চুপ,নাক বোঁচা।" বলেই মুখ
ভেঙ্গচি কেটে দৌড়ে রুমে চলে আসলাম।
পরদিন,
স্কুলে আমার ব্যাগ থেকে রাবার
চুরি করে ধরা খায় কোবরা। অনেক
বকা দিয়েছে শাপলা ম্যাম। আর,আমার
১২টা রাবার ফেরত পাওয়ার খুশিতে,
আমিতো ধেই ধেই করে পুরো বাসা মাতিয়েছিলাম।
আর,কোবরাটাকে ম্যাম খুব বকেছে তাই আনন্দ
সীমা ছাড়িয়ে গেল আমার। বাসায়
এসে আম্মুকে বলেছি, কোবরার বাসায় বিচার
দিতে। কোবরা নাম শুনেই ডলি দিদি হেসে কুটি কুটি।
সেদিনই,কোবরা আমাকে প্রথম সরি বলেছিল।
আমি বেলকুনিতে বসে অংক কষছিলাম, তখন।
আমিতো অবাক।
কোকরা চুলের নাক বোঁচা ছেলেটির চোখে সেদিনই
মায়া দেখেছিলাম আমি।
মুখটা কালো করে কোবরা বললো,"সরি,জানো আম্মু
আমাকে খুব মেরেছে।"
কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমিও
বললাম,
"বেশ করেছে। তুমি যেমন পাজি,
এমনি হওয়া উচিত।"
***
ধীরে ধীরে কোবরার সাথে দা-কুমড়া সম্পর্কের
ইতি ঘটতে থাকলো। কোবরার বাবা চাকরি করত।
ওর ফ্যামিলিতে তেমন কেউ নেই। কোবরা ছিল
বাবা-মায়ের একমাএ সন্তান।
আর,কোবরা ইংরেজিতে খুব দুর্বল ছিল।
চন্দনা ম্যামের মাইর একদিনও মিস হতো না।
কিন্তু চঞ্চল আর দুষ্টামি ভরা ছেলেটা ছিল
দুরন্ত। তাই রোজই,আন্টি বাসায় মারত।
আর,বেলকুনিতে প্রতিদিনই কোবরার গল্প-
গাঁথা শুনতে হতো আমার। কোবরা দুষ্টুমির জন্য
পড়াশোনায় বেশ অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল।
তাই,আন্টি ডলি দিদিকে বলেছিল
কোবরাকে পড়াতে।
আমাদের ফ্রেন্ডশীপ আরো গভীর হলো।
কোবরা পড়াশোনায় ভাল রেজাল্ট করতে শুরু
করলো। আমি আর
কোবরা মাঝে মাঝে বিকেলে মাঠে খেলতে যেতাম।
মাঝে বেশ কয়েকদিন আর কোবরাকে বাসায়
বা স্কুলে দেখি নি। ডলি দিদির কাছেও
পড়তে আসেনি কোবরা। কিছুটা চিন্তায় পড়ে যাই
আমি। ডলি দিদি আজ স্কুল থেকে বাসায় যেতেই
বলে,কোবরা অসুস্থ। বিকেলে ডলি দিদির সাথে কিছু
ফ্রুটস নিয়ে কোবরার বাসায় গেলাম।
আন্টি বললো,কোবরা দুষ্টুমি করে তাই আন্টি রাগ
করে কোবরার মাথায় মাঝারি সাইজের
ফুলদানিটা ছুড়ে মেরেছেন। আর,কোবরার
মাথা ফেটে যায়। আমি কিছুক্ষন হতভম্ব
হয়ে তাকিয়ে থাকি আন্টির দিকে।
তারপর, আমি কোবরার রুমে গেলাম।
কোবরা শুয়ে ছিল। আমাকে দেখে কোবরার
চোখে মিখে উচ্ছ্বলতার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল।
মুখে এক চিলতে হাসি এনে বলি,
"ওই!!নাক বোঁচু। এখন কি অবস্থা তোমার??"
মুখ গোমরা করে কোবরা বললো,
"তুমি বেশ খুশি হয়েছো তাই না খুকি?"
চোখের জল যেন বাধাঁহীন
হয়ে ঝরছিল,কথাটা শুনার পরেই।
আমি চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ পর বলি,
"নিজের যত্ন নিও।"
তারপরই চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে আসি।
পেছন থেকে অবশ্য কয়েকবার ডেকেছিল কোবরা।
আমি কর্নপাত করিনি।
দরজাটা জোরে ধাক্কা মেরে,সোজা বাসায়
চলে আসি।
***
রাতে টেবিলের উপর উঠে দুষ্টুমি করছিলাম
ডলি দিদির সাথে। পাশেই ছিল স্টিলের
আলমিরাটা। আমি একেবারে টেবিরের কোল
ঘেষে বসেছিলাম। আব্বু বারবার নিষেদ
করছিল,টেবিলে না বসতে। আমি পেছনে একবার
তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে টেবিল থেকে পড়ে যাই।
সোজা গিয়ে পড়ি আলমিরাটার কাছে। আর
আমার মাথাটা গিয়ে পড়ে স্টিলের আলমিরার
পায়ের উপর। মুহুর্তেই মাথা থেকে রক্ত
এসে কপাল ছুয়ে গাল বেয়ে পড়তে শুরু করলো..
পরের দিন,
কোবরার সাথে বেলকনিতে দেখা হলো।
আমি বসে ছিলাম চেয়ারে। আমার মাথায়
ব্যান্ডেজ থেকে রীতিমত চোখ বড় হয়ে গেল
কোবরার।
কোবরা ডেব ডেব
করে তাকিয়ে বলে,"কিভাবে হলো?"
আমি মাথা নিচু করে শুধু এতটুকুই বলি, "তোমার
সেদিনের প্রশ্নের জবাব।"
সেই থেকে কোবরা আমাকে একরকম মায়ার
চোখে দেখত। আর,দেখতে দেখতেই
চলে এলো আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা।
বেশ ভাল ভাবেই পরীক্ষা দিয়ে শেষ
করি আমি আর কোবরা। স্কুল বন্ধ পরে গেল।
শীতের দিন আর ছুটি গুলো কোবরার
সাথে কাটছিল বেশ। আর আমাদের ছোট্ট কুঁটির
বেলকনিটাতে আমাদের আড্ডাবাজিটাও দারুন
গতিতে জমছিল।
ডিসেম্বর মাসের প্রায় শেষদিক। ২৬তারিখ,
রেজাল্টের দিন। সকালে বেলকনিতে গ্রিল
ধরে দাড়িয়ে ছিলাম। কোবরা বল নিয়ে খেলছিল।
দেখেই কোবরাকে ডাক দিলাম। কর্নপাত
করলো না বরং খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
কিছুই বুঝলাম না,আমি রুমে চলে এলাম।
রেডি হয়ে স্কুলে গেলাম ডলি দিদির
সাথে রেজাল্ট আনতে। ক্লাসে কোবরা আমার
পাশের বেঞ্চে বসেছিল। আশ্চর্য!! কোন কথাই
বললো না।
আমি তৃতীয় হয়েছি। কোবরাটা সবাইকে অবাক
করে দিয়ে প্রথম স্থানটা দখল করে নিল।
আমাকেও পিছে ফেলে দিল নাক বোঁচুটা। আশ্চর্য!!
রেজাল্ট দেয়ার পর সবার মুখেই হাসি,এক
কোবরাকে ছাড়া।
আমি এগিয়ে গিয়ে কোবারাকে বললাম,"নাক বোঁচু
লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সাথে কম্পিটিশন
করে পড়েছিস, তাই না?"
কোবরাটা হু হু শব্দ করে কেঁদে উঠে বললো,"এসব
চাই না আমি খুকি।"
আমি ব্রু কুচকে বলি, "মানে?"
" অফিস থেকে ট্রান্সফার
করছে আব্বুকে খাগড়াছড়ি।
আমরা আগামীকাল চলে যাচ্ছি । "
কথাটা বলেই চিলের মত করে ছোঁ মেরে দৌড় দিল
কোবরাটা।
আমি হতভম্ব হয়ে কোবরার চলে যাওয়া দেখলাম।
পরক্ষনেই আমার চোখ জোড়া থেকে বিন্দু বিন্দু
মুক্ত দানা ঝরতে শুরু করলো। গালে হাত
দিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি সত্যি সত্যিই নাক
বোঁচুটার জন্য কাঁদছি।
***
পরদিন সকালে,একটা ট্রাক এসে কোবরাদের
বাসার সামনে দাড়ালো। সারাদিন
ধরে ট্রাকে মালপএ রাখা হলো। আজ প্রায়
সারাক্ষণ বেলকনিতে ঘুরঘুর
করেছি,একবারো কোবরাটাকে দেখলাম না।
বিকেলে কোবরা আন্টিকে নিয়ে বাসায় এসেছিল
বিদায় নিতে। তখন আমি শুয়ে ছিলাম।
"খুকি,উঠো.."
আমি উঠে বসলাম।
মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,"কিরে নাক বোঁচু?"
কোবরাটা কিছুই বললো না,শুধু
একটা রেপিং পেপার দিয়ে মুরানো বক্স আমার
হাতে গুজে দিল।
"কি এটা? "
কোবরা আমার কানের কাছে মুখ
রেখে বললো,"অরিন খুব ভাল থেকো।"
এই প্রথম কোবরা আমার নাম ধরে ডাকলো।
আমার নিজের কানকে বিশ্বাস
করাতে পারছিলাম না।
কোবরা চলে গেল।
কোবরা আমাকে একটা ঘড়ি দিয়েছিল। আমিও
কোবরাকে অনেকগুলা কার্টুন সেপ রাবার গিফট
করি। স্মৃতি হিসেবে ঘড়িটা আজও নাক বোঁচুটার
কথা মনে করায়। এখন আর কেউ এই
মেয়েটাকে খুকি বলে ডাকে না। নাক
বোঁচুটাকে এখনও খুব মিস করি।
স্মৃতিগুলো বাধনহারা,এখন আর কেউ ধুপধাপ শব্দ
করে সারা বাসা মাথায় তুলে না.....
- Blogger Comment
- Facebook Comment
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment