আশ্চর্য হাস্যদৃশ্য

(কৌতুক-১):
টিভির এক চ্যানেলে গতানুগতিক লাইভ প্রোগ্রাম হচ্ছে। উপস্থাপিকাঃ হ্যালো, আপনি কোথা থেকে কল করেছেন? কলারঃ ঢাকা থেকে
উপস্থাপিকাঃ ঢাকার কোথা থেকে?
কলারঃ লালমাটিয়া
উপস্থাপিকাঃ ওয়াও! আমিও লালমাটিয়াতে থাকি! লালমাটিয়ার কোথায় থাকেন আপনি?
কলারঃ আমিনুদ্দি এপার্টমেন্টে
উপস্থাপিকাঃ কি আশ্চর্য!! আমিও তো ওই এপার্টমেন্টে থাকি!! আপনার ফ্ল্যাট নাম্বার কত??
কলারঃ আরে উজবুক! আমি তোমার স্বামী! বাসার চাবি তুমি কোথায় রেখে গেছো!”
হাস্য গবেষণা কেন্দ্রের মিটিংয়ে কৌতুকটি পরিবেশিত হলো। তারপর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন এলো এরকম, "কৌতুকটিতে বেশ কয়েকটি গলতি রয়েছে। প্রথমত, স্বামী ভদ্রলোক প্রথমেই কেন বললেন না চাবির কথা? দ্বিতীয়ত, এখানে লালমাটিয়ায় বসবাসরত বিবাহিতা নারীদের মোটাদাগে উপস্থাপন করে এক ধরনের বৈষম্য প্রকাশিত হয়েছে। কল্পিত কোন নাম ব্যবহৃত হলে সমস্যাটা কাটানো যেতো। তৃতীয়ত, উপস্থাপিকা মহিলা টেলিফোনে তার স্বামীর গলার স্বর চিনতে এত সময় নিলেন কেন? তবে কি এটা আমাদের সমাজের ভেঙে পড়া দাম্পত্য ব্যবস্থাকে আরো উশকিয়ে দিতে উৎসাহ যোগাবে? এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চতুর্থত, স্বামী ভদ্রলোক উজবুক গালি দেয়ায় উজবেকিস্তানের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন, যেটা স্পষ্ট রেসিজম। সবদিক বিবেচনা করে কৌতুকটিকে হাস্য অনুপযোগী বিবেচিত করা হলো"। ঢাকা শহরের হাস্য গবেষণা কেন্দ্রের বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। এই অঞ্চলের মানুষ হাসতে ভুলে গেছে। যদিও পৃথিবী এখন খাদ্যে, প্রাচুর্যে, বিত্তে, বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, সবার জন্যে রয়েছে কাজ এবং বাসস্থান। তারপরেও ঢাকার মত বিভিন্ন শহরে মানুষ হাসতে ভুলে যাচ্ছে। এটা আদতে কোন সমস্যা ছিলো না, কারণ হাসতে না পারলেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, কাজ করতে পারে। তবে হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা হঠাৎ করে বাড়তে থাকলে এটা নিয়ে একটা সমীক্ষা চালানো হয়, এবং সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে হাস্যহীনতার দরুণ মানুষ স্নায়বিক এবং উচ্চরক্তচাপে ভুগে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে করে শহরের কর্মযজ্ঞ ব্যাহত হলে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে গুরুত্বের সাথে নেয়, এবং হাস্য গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত করে। বর্তমানে হাস্য গবেষণা কেন্দ্রের কর্মপরিধি ব্যাপক। এখানে মোটা বেতনে চাকুরী করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মেধাবী ছাত্র ছাত্রীরা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী আমলারা পায়াভারী পদবী বগলদাবা করতে ছাড়েন না। সরকার হাস্য মন্ত্রনালয়ও খুলেছে হাস্য উন্নয়নের জন্যে। প্রচুর টাকা, প্রচুর মেধা ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মানুষ হাসছে না। হাস্য গবেষণা কেন্দ্রের একটি বড় শাখা হলো কৌতুক গবেষণা। আগেকার যুগে মানুষ কী ধরনের কৌতুক পড়ে হাসতো তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয় এখানে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তারা এমন একটি কৌতুক রচনার গবেষণায় মশগুল যা মানুষকে হাসাবেই। তাই জনপ্রিয় প্রাচীন কৌতুকগুলোকে কাটাছেড়া করে তা যুগোপোযোগী করা যায় কী না সেটা নিয়ে তারা এন্তার ভাবছেন।
(কৌতুক-২):
রাতের বেলা চান্দু ঘুমাতে গেলো। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে সে মশারি টানালো। কিন্তু ভুলক্রমে একটা জোনাকি পোকা মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল। বাতি নিভানোর পরে চান্দু যখন জোনাকিটা দেখল তখন হাহাকার করে উঠে
বলল...হায় হায়!! মশা তো আমারে টর্চলাইট জ্বালাইয়া খুঁজতেছে! আমি এখন কই যাই?"
গবেষণালদ্ধ ফলাফলঃ
এই কৌতুক থেকে আমরা দেখতে পাই, চান্দু নামের যুবকটি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন। তাই জোনাকি আর মশার মধ্যে তফাৎ বোঝার সক্ষমতা তার ছিলো না। মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা একজন মানুষকে নিয়ে হাস্যরস সমীচীন নয়। অথবা এমনও হতে পারে, সে নেশাগ্রস্ত। তাই তার স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পেয়েছিলো। নেশার করাল গ্রাসে যুবসমাজ আক্রান্ত। সেটাকে গ্লোরিফাই করে কৌতুক বানিয়ে হাসাটা রীতিবিরুদ্ধ। এছাড়াও চান্দুর জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে আমরা দেখতে পাবো, সে একজন দরিদ্র এবং উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। কোনো স্বাভাবিক পরিবার তাদের সন্তানাদির নাম চান্দু রাখবে না। চান্দু নামটি অপরাধপ্রবন মানুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে কি এটা তাদের নতুন কোন অপরাধের পায়তারা? অনেক অসঙ্গতি এবং অপ্রীতিকর বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত কৌতুকটিকে হাস্য অনুপযোগী ঘোষনা করা হলো।
মানুষ হাসছে না, মানুষ মরছে। মানুষ হাসছে না মানুষ কাঁদছে। মানুষ হাসছে না, তবুও ভালোবাসছে। বিজয়ী মানুষ হাসছে না। আনন্দাশ্রূ বলে কিছু নেই। আছে শুধু বেদনার অশ্রূ। এমন কী কিছু কিছু শিশুও জিনগতভাবে বিবর্তিত হয়ে হাস্যহীন হয়ে জন্মাচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে দুর্গমতম অঞ্চলেও হাস্যহীনতার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ বিজ্ঞ ব্যক্তিই মনে করেন কারণটা সামাজিক না, জীবতাত্ত্বিক। নইলে না হাসার তো কোনো কারণ নেই। ভয়ানক কোনো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে হাস্যআলস্য তৈরি করছে বলে তাদের ধারণা। এর স্বপক্ষে অবশ্য এখনও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। সমাজ গবেষকেরা বলেছেন অঞ্চলভেদে মানুষের হাস্য উৎপত্তির কারণ বিভিন্ন হতে পারে। সবার এমন সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না। হাসিমুখ কমছে তো কমছেই। আর হাস্য গবেষণা কেন্দ্রগুলো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই...
(কৌতুক-৩):
এক ক্রেতা একটি ব্যাগের দোকানে গিয়ে দোকানদারকে বলছে ক্রেতা: তাড়াতাড়ি আমাকে একটা ব্যাগ দিন তো! ট্রেন চলে যাচ্ছে। ট্রেন ধরতে হবে !
দোকানদার: দুঃখিত। ট্রেন ধরার মতো এতো বড় ব্যাগ আমার দোকানে নেই।
গবেষণালদ্ধ ফলাফল: যান্ত্রিক সভ্যতাকে তুচ্ছ করে দেখা হয়েছে এই কৌতুকে। আমাদের মহান যন্ত্রাদীই তো সর্বোৎকৃষ্ট অবলম্বন। ট্রেন নামক যানটি যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। একসাথে এত মানুষ আর কোন মাধ্যমে পরিবহন করা যায় না। সেই ট্রেনকে ব্যাগের মাধ্যমে ধরতে চাওয়ার যে হীন প্রচেষ্টা তা নিঃসন্দেহে আমাদের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অতএব, এটি হাস্য অনুপোযোগী।
(কৌতুক-৪):
মেয়ে দেরী করে বাড়ি ফিরলো|
বাবা জিজ্ঞাসা করলো “কোথায় ছিলে ?”
মেয়ে বললো -বন্ধুর বাসায় ।
বাবা মেয়ের সামনেই তার দশজন বন্ধুকে ফোন দিল ৪ জন বললো “ও তো এখানেই ছিলো”
২ জন বললো “ওহ আংকেল! ও তো এই মাত্র বের হয়ে গেল”!
৩ জন বললো “ও তো আমার বাসায় ।পড়ছে । ও কে কি ফোনটা দিব?”
শেষজন আরো এক কাঠি সরেস । সে বললো “হ্যা ,বাবা, বলো…”
গবেষণালদ্ধ ফলাফল: গণমনস্তাত্ত্বিকমনোসংবেদনশীলতারএকটি করুণ উদাহরণ। আজকালকার মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নিজেদেরকে আর আলাদা ভাবতে পারছে না। সবে মিলে এক বিশাল একীভূত অস্তিত্ত্ব হিসেবে ভাবছে নিজেদের। এর ফলে মিথ্যে কথা বলার প্রবনতা বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পিতার প্রতি আনুগত্য। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো তারা নিজেদের আলাদা করে চিনতে পারছে না। এ সংক্রান্ত নথি নারী মন্ত্রনালয়ে পেশ করার জন্যে বলা হলো।
(কৌতুক ৫):
হাবলু নতুন টেলিভিশন কিনেছে। বাড়ি ফিরেই সে টেলিভিশনটা এক ড্রাম পানির ভেতর ডুবিয়ে দিল।ঘটনা দেখে ছুটে এলেন এক প্রতিবেশী। প্রতিবেশী: আরে, করছ কী, করছ কী?!
হাবলু: আর বলবেন না। নতুন টিভি কিনলাম।দোকানদারবলল, রঙিন টিভি! ভাবলাম, ব্যাটা ঠকিয়ে দিল কি না, তাই পানিতে ডুবিয়ে দেখছিলাম,রং উঠে যায় কি না!
গবেষণালদ্ধ ফলাফল: আবারও মহান যন্ত্রের ওপর আঘাত। আবারও সেই হীন ষড়যন্ত্র। সাদাকালো টেলিভিশন বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। সুতরাং এখানে সাদাকালো বা রঙীন যাচাই করার কোন সুযোগ নেই। কৌতুকটির প্রাচীনত্ব বিবেচনায় নিলে তো আরো ভয়াবহ বিপদ। পৃথিবীর অনেক অধিবাসীই যান্ত্রিক সভ্যতা, ঘন্টা বেঁধে দেয়া জীবনে খাপ খাওয়াতে না পেরে অরণ্য অভিবাসী হবার কথা ভাবছে। কেউ কেউ পুরোনো জিনিস ফিরিয়ে এনে সভ্যতার অগ্রগতির চাকা বন্ধ করার কৌশল ফাঁদছে। এক্ষেত্রে রঙীন আর সাদাকালোর বিভাজন প্রকট করে তুললে তা আমাদের অর্জিত উন্নতি এবং মহান যন্ত্রাদির প্রতি হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে মানুষকে অতীতচারী করে দিতে পারে। আমরা পশ্চাদপদ হতে চাই না। স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকার রোমান্টিসিজম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুতরাং অবশ্যই এটি হাস্যউদ্রেককারীনয়, বরং বিপদজনক হিসেবে বিবেচিত হবে। মানুষ নির্বিকার মুখে কাজ করে যায়। দেশে এখন কোনো বেকার নেই। মানুষ অবলীলায় অন্যজনের গলায় ছুরি চালায়। কারো কোনো বিকার নেই। শহরে খুনী বাড়ছে। পেডোফিল বাড়ছে। ধর্ষণ প্রতিদিনকার ব্যাপার। শহর থেকে দেশ, দেশ থেকে মহাদেশে, পুরো পৃথিবীতে ঘোর ডিসটোপিয়া। মানুষের অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে মানচিত্রে। ভূমি আর তেল দখলের জন্যে যুদ্ধাবস্থা চতুর্দিকে। প্রতিটি দেশেরই এখন আছে নিজস্ব পারমানবিক সমরাস্ত্র। অস্ত্র আর যন্ত্র ঈশ্বরকে হটিয়ে দিয়ে শীর্ষস্থানে এখন। চারিদিকে কাজ। চারিদিকে মেশিনের শব্দ। চারিদিকে যুদ্ধ। চারিদিকে মৃত্যুর স্পর্শ। হয় কাজ, নয় যুদ্ধ, চালাও যন্ত্র, ধরো অস্ত্র! সভ্যতার শীর্ষবিন্দুতে এসে এটাই এখন মূলমন্ত্র মানুষের। এই বিশ্বাস মানবজাতির মধ্যে জন্মেছে যে যন্ত্র দিয়ে যেকোন কিছু পাওয়া সম্ভব। অস্ত্র দিয়ে যেকোন স্থান অধিগ্রহণ সম্ভব। এই সব সম্ভবের যুগে উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছে মানুষ হাসতেই পারতো প্রাণখুলে। কিন্তু কোথায় হাসি? কোথায় সে বিলীন? বায়োলোজিকাল, মেটাফিজিকাল, সোশাল, সব ধরণের গবেষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাসি উধাও। হাস্য গবেষণা কেন্দ্রগুলিতে কারিকুলাম ভিটা জমা পড়ছে সবচেয়ে মেধাবীদের।
(ইন্টারভিউ-১):
-আপনি হাস্য গবেষণা কেন্দ্রে কেন কাজ করতে চান?
-আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে।
-একটু বিস্তৃত করে বলুন।
-এই যে হঠাৎ করেই মানুষ হাসতে ভুলে গেলো...
-হঠাৎ করে না। এটা এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি। আপনি আসতে পারেন এখন।
বাতিল!
পান থেকে চুন খসলেই প্রার্থীকে বাতিল ঘোষণা করা হয় এখানে। হাস্য গবেষণা কেন্দ্রগুলিতে সবচেয়ে মেধাবীরাই কেবল কাজ করতে পারে। আগে যেমন ছিলো নাসা।
(ইন্টারভিউ-২):
-আপনি হাস্যবিলুপ্তির ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
-যতটুকু পারি জেনেছি।
-তা তো মুখস্থ অনেকেই বলতে পারবে। ব্যাপারটা আসলে আপনাকে ভাবতে হবে সভ্যতার উৎকর্ষের মন নিয়ে। মহান যন্ত্রের দর্শন অনুধাবন করে। অস্ত্রের অধিকারসূচক বিস্ফোরনে।
-হ্যাঁ, আমি জানি সেটা। হাসির বিষয়গুলো অবশ্যই হতে হবে যন্ত্রসম্মত এবং সভ্যতার অনুগামী। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানি যে, হাসি দেহকে সচল রাখে। ফলে মানুষ দীর্ঘদিন কাজ করতে এবং বাঁচতে পারে। সভ্যতার জন্যে এটা শুভ বিষয়। এছাড়া হাসিকে খুঁজে ফেরার কোন যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না।
সিলেক্টেড।
(কেস স্টাডি স্থান- ল্যাবরেটরি, হাস্য গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা) গম্ভীরমুখো প্রফেসর গুরুত্বের সাথে একটি জীবন্ত নমুনা বিশ্লেষণ করছেন।
"এখানে দেখতে পাচ্ছেন একজন পাহাড়ী তরুণকে, যে এখনও হাসতে জানে। সে সময়ে অসময়ে, কারণে অকারণে হাসে। আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মনে হলেও তার এই অফুরান প্রাণচাঞ্চল্যেরমর্মোদ্ধার করতে পারলে আমরা হাস্য উৎপত্তির ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে যাবো।"
তরুণটি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসে। দরাজ গলায় একটা প্রাচীন গান ধরে,
"তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা রাঙামাটির দেশে যা ইথাক তুকে মানাইছেনা রে ইক্কেবারে মানাইছেনা রে"
"আমাদের গবেষণালদ্ধ ফলাফলে দেখতে পাচ্ছেন, তার হাসির কার্ভটা শহরে আসার পরেই হঠাৎ ফল ডাউন করেছে আকস্মিকভাবে। আমরা এর কারণ অনুসন্ধান করে বের করবো।"
উৎসুক প্রশিক্ষনার্থীরা এগিয়ে আসে। তারা নানা প্রশ্ন করতে থাকে পাহাড়ী যুবকটিকে। এভাবে এক সপ্তাহ পার করার পর যা হয়, তা হলো আরো একজন হাস্যলুপ্ত মানুষের আবির্ভাব ঘটলো।
গবেষণাগার থেকে বাইরে পাঠিয়ে তাকে একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে সেঁধিয়ে দেয়া হলো। প্রশিক্ষনার্থীরা আলোচনা করতে থাকে এই বলে যে, খুব কাছাকাছি পৌঁছুনো গিয়েছিলো এবার। হাসিকে শক্তিতে রুপান্তরিত করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করতে উৎসাহী একজন পদার্থবিদ তো বলেই ফেললেন আর মাত্র একমাসের মধ্যেই হাসির রহস্য উদঘাটিত হবে। মানুষ হাসবে, প্রাণপ্রাচুর্যেবলীয়ান হয়ে দেশকে আরো যন্ত্রবতী এবং অস্ত্রবতী করে ফেলবে। নতুন একটা পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এসময় প্রচুর শ্রম এবং শক্তি প্রয়োজন। এই অস্ত্রটা পৃথিবীর তাবৎ মোড়ল আর তার সাঙ্গপাঙ্গ ষণ্ডাগুণ্ডাদের সিধে করে দেবে। এখন হাসির অভাবে যদি কিছু শক্তি নষ্ট হয়ে কাজের গতি মন্থর করে দেয়, আখেরে তার জন্য দেশকে কঠিন মাশুল দিতে হতে পারে।
(বিশেষ সভা):
পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে জাতিসংঘ তার সকল সদস্য দেশগুলিকে নিয়ে একটি বিশেষ সভা আহবান করেছে। মোটামুটি সব দেশই এই সমস্যায় আক্রান্ত। গ্লোবালাইজেশনেরকঠিন শিকলে সবাই বাঁধা। তাই শিকলের একপাশ আক্রান্ত হলে আরেক পাশ কি আর স্থির থাকতে পারে? তবে এই গুরুতর পরিস্থিতিতেও জাতিসংঘ মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান অসম যুদ্ধ স্থগিত করতে পারে নি। বলা ভালো, চেষ্টাই করে নি তেমন। এজন্যে অবশ্য অদৃশ্য পিঠ চাপড়ে দেয়ার লোকজন আছে। সবাই জানে তারা কে, কিন্তু কেউ বলছে না। জাতিসংঘের মহাসচিব তার বক্তৃতা শুরু করলেন। সব ভাষায় তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুদিত হয়ে পৌঁছে গেলো প্রতিটি রাষ্ট্রের নিযুক্ত দূতের কাছে। কথা তো সেই একই, সেই গৎবাঁধা বুলি, মানুষ হাসতে পারছে না। এর ফলে অনেক শক্তির অপচয় ঘটছে। হাস্য গবেষণা কেন্দ্রগুলো কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু কাঙ্খিত ফলাফল আসছে না। ইত্যাদি। সবাই যখন আলোচনায় অথবা ঝিমুনিতে ব্যস্ত তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। কোথা থেকে যেন একটা কাগজ উড়ে এলো মহাসচিবের কাছে।
আশ্চর্য সে কাগজ। কতরকম বর্ম আর বুহ্য ভেদ করে ঠিক ঠিক ঢুকে গেলো! হালকা নীলচে রঙের লাইনটানা কাগজ। সুপ্রাচীন এক বস্তু।
সেই কাগজের ইতিহাসটা দীর্ঘ।
(আশ্চর্য কাগজ):
এখানে মিশে আছে ভাবুক কবির রাতজাগা অস্থিরতা, প্রণয় অপেক্ষায় অস্থির হয়ে থাকা চপলা তরুণী, পাখিদের ঠোঁট, মেঘেদের খুনসুটি, জোনাকির ওম, শিশুর গায়ের ঘ্রাণ, ঘাসের নুপুর, বুনোহাসের টাপুর টুপুর। কোন এক বর্ষারাতে ছাদে গান করতে থাকা যুবকের দল হয়তোবা এই কাগজে লিখেছিলো দারুণ নতুন কোনো গান। অথবা অভিমানী কোনো বালক চুপদুপুরে লিখেছিলো ঘর ছাড়ার পিছুটান! হয়তোবা সেই কাগজটা ছিলো কোনো ব্যর্থ কবির কবিতা লেখার চেষ্টায় ক্রমাগত কাটাকুটি করে যাওয়া। যারই হোক, এই কাগজ ছিলো না যন্ত্রের, ছিলো না অস্ত্রের, ছিলো না ভূমি অধিগ্রহণের মরণপন লড়াইয়ে, ছিলো না তেল উত্তোলনের উত্তাল সমরে, ছিলো না পারমাণবিক বোমার প্রনেতা বিজ্ঞানীর হস্তে। সেই কাগজটা পড়ে ছিলো কোন গুহায়, বা সমুদ্রতটে অথবা নিঝুম অরণ্যে। বছরের পর বছর, নির্জীব। তার হঠাৎ ডানা গজালো পাখিদের মতো, পরীদের মতো, আর সে উড়ে চললো বিশ্বসভার মধ্যলগ্নে।
এই কাগজের জন্যে কোনো অনুবাদক যন্ত্র নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, সবাই ঠিকঠাক পড়তে পারছে এর দুর্বোধ্য লিপি। আর তার চেয়েও আশ্চর্য, এসব পড়ে তারা হাসছে! এতদিনের গবেষণায় কোনো ফল পাওয়া যায়নি, মেধাবী বিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিকরাব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু এই আশ্চর্য কাগজের অবাক অক্ষরগুলো এই অসাধ্য সাধন করলো কত আয়েশে! শুরুটা হলো মহাসচিবকে দিয়ে। কাগজটার হঠাৎ উড়ে আসায় বিরক্ত হয়ে তিনি যখন এটাকে ছুড়ে ফেলে নিরাপত্তারক্ষীদের গাফিলতির কারণ অনুসন্ধান করে আচ্ছা করে কড়কে দিবেন বলে ভাবছিলেন, তখনই কাগজের অক্ষরগুলো তার কাছে স্পষ্ট হতে থাকে, এবং তিনি এর মধ্যে তুমুল হাস্যরসের উপাদান খুঁজে পান। সেখানে ছন্দে ছন্দে লেখা ছিলো,
যুদ্ধ না করিলে পরে
দেখো কত মানুষ বাঁচে
করিলে আক্রমন অপরে
নিজে কি জ্বলবেনা আঁচে?
তিনি হলরুম কাঁপিয়ে হেসে ওঠেন। কাগজটা উড়তে উড়তে প্রতিটি রাষ্ট্রের নিয়োজিত প্রতিনিধিদের কাছে যেতে থাকে। আর একজন করে হাস্যরত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কখনও সেখানে সূক্ষ্ণ অর্থবাহী ছড়া, কখনও সেখানে বলিষ্ঠ শ্লোগান। দেশের সাথে সাথে কাগজের লেখাটাও পাল্টাতে থাকে। যেমন, জাপানের প্রতিনিধি পড়লেন এভাবে, "অধিক শ্রম দিয়ে নিজেদের যন্ত্রের দাসানুদাস করে কি সুখ পান আপনারা? ছুড়ে ফেলুন এই যান্ত্রিক, প্লাস্টিক সভ্যতা!" এটা পড়ে হাসতে হাসতে ক্ষুদ্র চোখগুলো ক্ষুদ্রতর হতে থাকলো জাপানিজ ভদ্রলোকের। আমেরিকার নিযুক্ত দূতের কাছে লেখাটা ছিলো, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সকল যুদ্ধের হোতা এই ঘৃণ্য আমেরিকা ধ্বংস হবে যেইদিন, সেদিন সভ্যতার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে"।
আমেরিকান ভদ্রলোক গমগমিয়ে হেসে উঠলেন। এভাবে স্থানান্তরিত হতে হতে শ্লোগানে, ছড়ায়, কবিতায়; শান্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্য, যুদ্ধবিরোধী, যান্ত্রিক সভ্যতা বিরোধী নানারকম কথকতা হাসির কৌতুক হয়ে বেদম হাসাতে লাগলো সবাইকে। সবার পড়া শেষ হলে কাগজটি ভগ্ন মনোরথে আবার উড়াল দেয় নতুন গন্তব্যের দিকে। এমন বিদঘুটে হাসির কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে নিজেকে অবহেলিত এবং অপমানিত মনে করছে সে। সে না হয় প্রাচীন কোন বৃক্ষের পাদদেশে অবস্থিত গুহায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে। উড়তে উড়তে সভ্যতার প্রতিনিধিদের সভাকক্ষ থেকে ভেসে আসা হাসির শব্দে স্বস্তি পেতে চাইলো একবার, কিন্তু সেটা আর মানুষের হাসির মতো লাগে না তার কাছে। হায়েনার ক্ষুধার্ত আস্ফালন মনে হয়। ছিড়ে-খুড়ে সব খেয়ে নিবে, সবারই অসীম ক্ষুধা, কিচ্ছু অবশিষ্ট রাখবে না আর। বোকা কাগজটা বুঝতে পারে, পাখি হওয়া হবে না তার আর। ডানাদুটো বুঝি খসেই যাবে এবার!
Share on Google Plus

About K. M. Emrul Hasan

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment